ভালবাসার সাতকাহন (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব- ১৫)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৯ অক্টোবর, ২০১৪, ০১:৪২:৪৬ দুপুর
বেশ কয়েক কালারের সূতা কিনতে এসেছে রায়হান।
রুমা কাঁথা সেলাই করবে। শুনে চমকে যাবার কিছুই নেই। মিতু আজকাল রেখা ম্যাডামের কাছে প্রাইভেট টিউশন নিতে যায়। সেই সুবাদে লেখক মিনার মাহমুদের পরিবারের সাথে একটু আধটু পরিচয় হয়েছে রায়হানদের। রায়হানদের বলতে রুমার-ই বলা চলে। কারণ রায়হান খুব একটা যে মিনার মাহমুদের বাসায় গিয়েছে, তাও নয়। রুমাই মিতুকে পড়ানোর সময় নিয়ে যায়। তবে বাসা কাছে বিধায় সেখানে অপেক্ষা করে না।
মিতুর রেখা ম্যাডাম একটা ছোট্ট মেয়ে বাবু দত্তক নিয়েছেন। মিতু দেখে এসেছে। সেই থেকে ওর যে কি উচ্ছ্বাস! নিজের পাপার সাথে এখন শুধুই মা’য়িশার আলাপ। রায়হানকেও আগ্রহ ভরে শুনতে হয়।
সেদিন রুমা আর মিতু বাবুটাকে দেখে এসে পরিকল্পনা করে, কি দেয়া যায়? কয়েকদিনের ভিতরে রেখা ম্যাডাম নাকি কয়েকদিনের জন্য ওনার শ্বশুর বাড়িতে যাবেন। সুন্দর কয়েকটি কাঁথা সেলাই করে দিলে কেমন হয়, হঠাৎ করেই রুমার মাথায় জেঁকে বসে।
তাই এখন রায়হানকে সাভারের মার্কেটে সূতার দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হতে হচ্ছে। তবে কষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত সবগুলোই পেয়েছে সে।
বাসে করে ফিরে আসার সময় এই কাঁথা প্রসঙ্গে বেশ আগের কিছু কথাবার্তা রায়হানের মনে পড়ে গেল। মিতুর জন্মের পরের কিছু ঘটনা।
রায়হানের সেই দিনটা মনে আছে।
রায়হানের মেয়ে মিতুর জন্মের পরে রায়হানের মা দেখতে এসেছিলেন। শাহেদ , বিথী এরাও এসেছিল। রায়হান রুমার সংসার তখন চট্টগ্রামে রুমার মামার বাসায়।
রাশেদ সাহেব কেন এলেন না সেটা একটা অনুচ্চারিত প্রশ্নবোধক হয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দেয়। এ কথা ও কথায় রুমার মামা মুরাদ সাহেব রায়হান রুমার এই অবস্থার জন্য আয়েশা বেগম এবং রাশেদ সাহেবকে দায়ী করেন। আয়েশা বেগম অনেকগুলো কাঁথা সেলাই করে এনেছিলেন। আরো নিজের মনের মত করে অনেক কিছু। কিন্তু এলাকার নিয়ম জানা না থাকায় তিনি প্রথম নাতি দেখতে এসেছিলেন স্বর্ণ ছাড়া। এতে লোকজনের সামনে মুরাদ সাহেবের নাক কাটা যায়। আগের রাগ, ভাগ্নির সেই সময়ের দুরবস্থা, সামনের দিনের জন্য সম্ভাবনা না দেখা - তার উপর লোকজনের উপহাসের ভয় সব এক হয়েই হয়তো শেষ পর্যন্ত নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রন রাখতে পারলেন না তিনি। আয়েশা বেগমকে যা তা বললেন। আনা জিনিসগুলো গ্রহণ না করে ফেরত দিয়ে দিলেন। চরম ভাবে অপমানিত হলেন আয়েশা বেগম।
ঘরে ফিরে যাবার পর আয়েশা বেগমের মন খারাপটা রাশেদ সাহেব বুঝে ফেলেন। শাহেদ রায়হানের বাসায় যা হয়েছিল বাবাকে বলে দেয়। এর জের ধরে রায়হানের সাথে তার বাবার গন্ডগোল চরমে পৌঁছাল। রায়হান তার মমতার আধার মাকে ওর সামনে অপমানিত হতে দেখেও কিছু বলল না - এটা রাশেদ সাহেবের মনে আঘাত হানল।
এক এক এলাকার কিছু নিয়ম আছে। এই সব রীতি রেওয়াজ ছোট থেকে বড় হওয়ার সময় সবার স্বপ্নের অনেকটাই জুড়ে থাকে। কিন্তু মানুষের তো নানান সীমাবদ্ধতা থাকে। বিয়ে শাদী বা আত্মীয় পরিজনের নিজস্ব লেনদেনে বাইরের লোকের কিছু বলার থাকতে পারে? উপহার পাওয়ার আনন্দ তো এ না। কেবলি আদায় করতে পারার দম্ভ। কেন এমন করে মানুষকে কিছু পেতেই হবে? কার জন্য? এক পরিবারের উপর আরেক পরিবারের আধিপত্য বিস্তারের জন্য? এর জন্য ভালোবাসা আর ক্ষমার চেয়ে বেশি উপযুক্ত অস্ত্র কী আছে? নিজ নিজ কৃষ্টির লোক দেখানো কিছু নিয়মকে ধরে রেখে নিজেকে বড় প্রমান করা যায়? এইসব প্রথা রীতি পালনের হাস্যকর প্রবনতা সম্পর্কগুলোকে কিভাবে নষ্ট করে দেয়! এর চেয়ে নিজের ধর্মটা পালনই কি বেশি দরকার না?
আজ রায়হান রুমার সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? এই সম্পর্কের আঁচ সন্তানের গায়ে কি লাগে না? সমস্ত আত্মীয় স্বজন বন্ধু এমনকি কাজের পরিবেশের সাথে সম্পর্ক ও কি কিছু না কিছু প্রভাবিত হয় না? কী লাভ হয়? কার সুখ হয়?
যা হয়েছিল তা ছাড়া আর কী হতে পারত সেদিন ?
সেই সময় সে শ্বশুরের আশ্রয়ে, বাবাও ওর উপর রাগ, আর নিজের মনে ও বাবার উপর রাগ। আসলে শুধু রাগ না। মনের অনেক ভিতরে দ্রুত বড়লোক হবার সুপ্ত বাসনা- বড় হয়ে বাবাকে দেখিয়ে দেয়া! অহংকার! হ্যা।
আরো কিছু ছিল।
নিজের জন্মদাত্রী মায়ের অপমান কি ওর বুকে বেঁধেনি? এই প্রশ্নটার উত্তরে রায়হান দেখল- রুমা না, সেদিন মিতুর মুখটাই বারবার মনে ভেসে উঠছিল। বিবাদ শুরু হওয়ার পর থেকে নিজের অজান্তেই রুমার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ জমা হচ্ছিল রায়হানের মনে। বিয়ের পর থেকে এই দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী - সহযোদ্ধা নারীকে কি এইজন্যই সময়ে অসময়ে অবহেলা অপমান করে সে? এইজন্যই। অথচ তার উপর সংসারের বেশিরভাগ বোঝাই কি সে তুলে দিয়ে নিজের নিশ্চিন্ত অবসর খুঁজে নেয়নি? হায়! কারো সাথেই কি সুবিচার করতে পারল না রায়হান?
সেদিন মায়ের দিকটা দেখলে রুমাকে আর মানানো যেত না। সে অনেক জেদী। হয়ত সংসারটা টিকতই না। মুরাদ মামা ঠিকই রুমার সাথে থাকতো। উনার সাথে রায়হান পারত না। রায়হান কি মেয়েকে ছেড়ে আসতে পারত? বিকল্প আর কি ছিল? অতটুকু বাচ্চাকে মা হারা করার চিন্তাও বা সে কিভাবে করতে পারত? রায়হানের এদিক ওদিক কোনো দিকেই যাওয়ার পথ ছিল না। আর নিজের পায়ের নিচে মাটি সরিয়ে বাবা হয়ে বাচ্চাটাকে অভাবের মধ্যে ফেলার চিন্তা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অভাব? না বিলাসিতা ছাড়তে না পারা?
বাবার থেকে রুমার মামার অবস্থা সেই সময়ে অনেক ভালো ছিল। এটা কি ওকে প্রলুব্ধ করেনি? বাবার কাছে গেলে না খেয়ে থাকতে হতো তা'তো না। সহজে, দ্রুত সমাজের মাথায় উঠার লোভ সে সামলাতে পারেনি। আকাশছোঁয়া হবার সুপ্ত বাসনা। পরিণতি কী হল?
শুধু লোভ না। পাপ তার আরও আছে। তার অলস ফাঁকিবাজ স্বভাবটা তার আত্মসম্মান বোধটুকুকেও অকেজো করে রেখেছিল! আরেকজনের উপর ভর করে পরাশ্রয়ী লতার জীবন সে ভালবেসেছে সারাজীবন! নিজেকে অপদার্থ ছাড়া আর কিছু মনে হল না রায়হানের। বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিয়েছে। কত বড় হয়েছে সে? আজ এইজন্যই সে কিছুই হতে পারেনি ।
লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। এই জীবন কি মৃত্যুর মতই না? আরো খারাপ। এসব মনে পড়লে প্রতিমুহূর্তে যে মৃত্যু যন্ত্রণা -কবরের আযাব - এর কি শেষ আছে? মা বাবার অভিশাপ কুড়িয়ে কেউ শান্তি পায়?
কী পেল সে? কেন আজ নিজেকে সর্বস্বান্ত মনে হয়? কেন সব কিছুকেই অর্থহীন মনে হয়? কেন ভুল মনে হয়?
শিউরে উঠল রায়হান।
নিজের ভিতরে আলো পড়তেই নিজের চেহারার কদর্যতা তাকে উদ্ভ্রান্ত অস্থির করে তুলল। ইচ্ছে হল সব ভেংগেচুরে ফেলে। অসহ্য আক্রোশে তীব্রস্বরে চিৎকার করে উঠল রায়হান - "আমি কেন এত খারাপ! কেন এত অন্ধকার! কেন এত কালো আমার ভিতর! "
নি:শব্দ এই তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আর কেউ শুনল না ,কিন্তু প্রশ্নগুলির প্রচন্ড প্রতিধ্বনিতে তার ভিতরের পৃথিবী কেঁপে উঠল। থরথর কাঁপতে থাকল এতদিনের ধ্যান ধারণা। আশা আকাংখার বিশাল বিশাল বিল্ডিং গুলি ঝুরঝুরে বালি হয়ে পড়ে যেতে থাকল। এক ধরণের প্রশান্তি বোধ করতে শুরু করল রায়হান। বুকের উপর থেকে বিপুল ভারের পাহাড় নেমে যাচ্ছে! দুটো লোনাজলের স্রোতে ভেসে গেল অতীত।
যাক! আবার নতুন করে সব হোক!
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৯৯ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বিমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন পাঠকে নিজের অজান্তেই 'রায়হান'এর সাথে মিলিয়ে দেখতে চায়-এক পলক!
'রায়হান' আর স্বীয় সত্বার মাঝে বেশী পার্থক্য খুজে পায় না যেন!
শুভকামনা রইলো।
অনেক ক্ষেত্রে অনিচ্ছায় জড়িয়ে যায় এমন কদর্যে। অথবা বাহ্যিক ভাবে মনে হয় কতটা কদর্য ওরা আসলে প্রকৃত ভাবে তা নয়।
আপনার কামনায় আমিন ছুম্মা আমিন।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।
শুভেচ্ছা রইলো।
নির্ভয়ে পড়তে পারো তুমি।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন